Wednesday, 23 June 2010
Saturday, 19 June 2010
Malay Roychoudhury's Selected Poems.
মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে দু-একটি কথা
উৎপলকুমার বসু
মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম ।
তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও পোলেমিক্স এর সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা ।
তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ 'সাহিত্যের সেবক' বললে আমাদের স্মরণে যে-ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেণীতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে--- আক্রন্ত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ।
গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে, সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা 'সংস্কৃতি'-র ঘরে তাঁর লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন ।
বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়া না-গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকেঅবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ বা চিত্রকল্পেরব্যবহার, মহাজাগতিক সচেতনতা, মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতে খড়ি হয়েছিল । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি । কথাপ্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন---'লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে'।
বলা বাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছেন 'পলিটি'-র কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব---মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন ।
(হাওয়া-৪৯ পত্রিকার বৈশাখ ১৪০৮ বা এপ্রিল ২০০১ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত )
ঘুণপোকার সিংহাসন
ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
ভূচর খেচর জলচর দাম্পত্যজীবনে তুষ্ট একশিঙা
নীলগাই বারাশিঙা চোরাকিশোরীর হাতে মূল্যবান প্রাণী
স্হলে বিচরণকারী উদবিড়াল গন্ধগোকুল বিনোদিনী
শব্দগহবর খেয়ে নোকরশাহির রাজ্য এনেছ এদেশে ।
২ ভাদ্র ১৩৯২
এ কেমন বৈরী
ভাবা যায় ? কোনো প্রতিপক্ষ নেই ।
সবকটা আধমরা হয়ে আজ শুয়ে আছে জুতোর তলায় ?
কিছুই করিনি আমি
কেবল মুখেতে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করেছি থেকে থেকে
হাহাহা হাহাহা হাহা হাহা
পিস্তল কোমরে বাঁধা তেমনিই ছিল সঙ্গোপনে
ক্ষুর বা ভোজালি বের করিনিকো
বোমাগুলো শান্তিনিকেতনি ব্যাগে চুপচাপ যেমন-কে-তেমন পড়ে আছে
আমি তো আটঘাট বেঁধে ভেবেছি বদলা নেব নিকেশ করব একে একে
সকলেই এতো ভিতু জানতে পারিনি
একা কেউ যুঝতে পারে না বলে দল বেঁধে ঘিরে ধরেছিল
এখন ময়দান ফাঁকা
তাবৎ মাস্তান আজ গরুর চামড়ায় তৈরি জুতোর তলায়
কিংবা পালিয়েছে পাড়া ছেড়ে কোনো জ্ঞাতির খামারে
আমি তো বিধর্মী যুবা এদের পাড়ার কেঊ নই
জানালার খড়খড়ি তুলে তবু যুবতীরা আমার ভুরুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে
ছ্যাঃ এরকম জয় চাইনি কখনো
এর চেয়ে সামনে শিখন্ডী রেখে জেতা ছিল ভালো
ভেবেছি চেংঘিজ খান যে-লাগাম ছেড়েছে মৃত্যুর কিছু পরে
তার রাশ টেনে ধরে চুরমার করে দেব এই সব জাল-জুয়াচুরি
আগুন লাগিয়ে দেব মাটিতে মিশিয়ে দেব ধুরন্ধর গঞ্জশহর
কিন্তু আজ সমগ্র এলাকা দেখি পড়ে আছে পায়ের তলায় ।
৪ মাঘ ১৩৯১
মেসোমশায় পর্ব
যুধিষ্ঠির
আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির
বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে
লিআয় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে-কে আছে
পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন
বলেদে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক
আমার সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই
থৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধন নেই
তোদেরই অঙ্গুলিহেলনে কেটে তর্জনীও দিয়েছি শৈশবে
দাঁড়াচ্ছি পা-ফাঁক করে দন্তস্ফুট হয়ে যাবে জয়ধ্বনি তোর
সিঁড়িতে শেকলবাঁধা মহাপ্রস্হানের কুত্তা লেলিয়েও দ্যাখ
ন্যাটা হাতে যুঝে যাব জমিন ছাড়ব না
লুমপেন বলে তোরা ঘিরে ধরবি
আরেকবার ছিটকে পড়ব ফুটপাথে মুখে গ্যাঁজলা নিয়ে
ছুটন্ত খচ্চরবাচ্চা পিঠের ওপরে খুর দেগে যাবে
নাভিতে ব্লেডের কুছি দিয়ে তোরা খোঁচা দিবি
পায়ধমুখে জ্বলন্ত সিগারেট
পাঁজরে আছড়ে পড়বে কম্বলে মোড়া সোঁটা
দেখে নিস তোরা
মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাব ।
২৭ বৈশাখ ১৩৯২
পালটামানুষ
আমি তো সুন্নত করে পালটে ফেলেছি ধর্ম
তাতার হয়েছি তাল ঠুকে
সম্রাট বদল হবে এইবার খুনখারাবা নষ্ট নারীলুট হবে
নাদির শাহের কাছে যেমন শিখেছি
তরোয়ালে চুমু খেয়ে বাতাসে লাফাব উল্লাসে
ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে মশাল হাতে এগিয়ে চলেছি আমি
ঘাঁটি পতনের দিকে
দুপাশে শহর জ্বলছে
কাঁখে শিবলিঙ্গ নিয়ে ল্যাংটো মোহন্ত ছুটছে
২৯ ফাল্গুন ১৩৯১
মুরগির রোস্ট
পালক ফুলিয়ে ক্রোধে লড়ো মুঘফা, চাকু-মালিককে খুশ করো
হুলেতে পরাগ মেখে ঝাপটাও ডানা
বলেওছি: দু-হাত মুচড়ে নতজানু করে রাখো
মাঝরাতে ঘুমভেঙে মাদুর গুটিয়ে নেমে এসো ছাদ থেকে
বুটজুতো - রাইফেল - ঘুরন্ত বুলেট - চিৎকার
বাড়ি নিয়ে চলো বলে কেঁদে ওঠে পাশের হাজতে বন্ধ বৃদ্ধ কয়েদি
ছেড়ে দাও
ছেড়ে দাও যেতে দাও বাড়ি যেতে দাও
ডিমের ওপরে বসে সিংহাসনে ঝিমৌয় ডাহুক
অন্ধকারে গলা টিপে ধরো
লড়ো মুর্গা, মরো লড়ে, গর্জাও গুঙ্গার দলে ঢুকে
জিভেতে কাঁচের ফুলকি -- নাচাচ্ছি বুকের পেশী
মাছের কানকো খুলে জলেতে কুয়াশা মিশিয়েছি
কড়ে আঙুলের টুকরো মোড়া ছিল গোলাপি কাগজে
দু-হাতে দু-চোখ ঢেকে কে কাঁদে হাউ-হাউ করে জেলখানায়
নারী না পুরুষ আমি বুঝতে পারি না
এ নাও চোখের পাতা -- ফুঁ দাও বাঁহাতে রেখে
শিশিরে ফণার পাঞ্জা খোলো
মেয়েলি হিসির শব্দে তলপেট কাঁপে জাত-গোখরোর
রক্ত গড়ালে নাকে তুলো গুঁজে শ্মশানে পাঠাও
রাস্তায় পড়ে থাকবে চটিজুতো ভাঙাইঁট ঠ্যাঙ টেনে ছেঁড়া পাতলুন
ঝড়ের সমুদ্র থেকে যে-ঢেউ খাবলে তুলে মেখেছি দুপায়ে
সে-নব বর্ণমালা থেকে আজ হরফ এনেছি
১২ চৈত্র ১৩৯২
যে-পার্টি চাইছেন সে-পার্টিই পাবেন
বিশ্বাস এক দুর্ঘটনা
বুকপকেটে শ্রেণি
প্রতিরোধী থাকেন জেলে
কাজু ফলের ফেনি
বরং ভালো
ভুল অঙ্কের ডানা
উড়বে হাগবে অ্যালজেবরার
বেঠিক উত্তরে
অম্ল-পিত্ত-কফের চাকে
বিশ্বাসী আস্তানা
মোড়ল দলের পাড়ার কেউ বা
আওড়ায় বেঘোরে
ছাদঢালায়ের সমরবাদ্য
কর্তাবাবার জানা
মেলাবেন তিনি অন্তরীক্ষে
মোক্ষ একখানা ।
কোম্পানি ল বোর্ডের আদেশ
হুইলচেয়ারে লীন প্রেসনোটে যে-সংগীত জারি করা হল তারই নীচে
গাছে-ডালে ঝুলে আছে শুনানি না-করা মামলা থ্যাঙ্কিউসহ
প্রকরণ তিন-এর উপ-প্রকরণ বাদ দিয়ে, লাভাংশ ঘোষিত হবে
গোধুলি-বেলায়, এই সাধারণ-সভা কোম্পানির পুরো-সময়ের পুত্রবধু
ডিরেক্টর পদে আজ নির্বাচিত হবেন নিশীথে
অনাদয়ী বিছানায় থাকা_খাওয়া বিমান ভাড়া বা
স্ব-স্ব পদে যে যারা দাঁড়াবে তিনি বোর্ডরুমে এসে
কায়াটি মাটিতে ফেলে ৩১শে মার্চের সাড়ে পাঁচটার আগে
ইকুইটি শেয়ারের প্রথম কাগজখানা বাজারে ছাড়বেন : ওরা পাবে
হলফনামার কপি বনপথে পাখির বাসার মাঝে যারা ফেলেছিল
১৯৯৬
লেটারবক্স পাড়ায় পশ্চিমবঙ্গ
আমাদের পাড়ার রাস্তাটার
এমন পালাই-পালাই ভাব যে
আদ্দামড়া স্হাপত্যের বাড়িগুলো
থিতিয়ে-আসা চাঁদের আলোয়
তিক্ততার নান্দনিক আনন্দে ভোগে
ইদিক-উদিক শেকল-বাঁধা ছায়ায়
যে-লোকগুলো আরাম ফিরি করে
তারা যে-গাছতলায় বসে চা খায়
সে-গাছ শেকড়ের দোষে নাচতে পারল না
তাই আঁটে-না-এমন জামাপ্যান্ট পরে
যখন বৃষ্টির কুচোকাচা দলবল দৌড়োয়
পালাতে পথ পায় না পাড়ার রাস্তাটা
কলকাতা ৩ জুলাই ২০০১
আমি ভঙ্গুর হে
আমি যে-নাকি গাইডের কাছে ইতিহাস-শেখা ফোসকা-পড়া পর্যটক
ছায়ায় হেলান-দেয়া বাতিস্তম্ভের আদলে গিসলুম পিতৃত্ব ফলাবার ইসকুলে
জানতুম যতই যাই হোক ল্যাজটাই কুকুরকে নাড়ায় রে
আমি যে-নাকি প্ল্যাটফর্মে ভবিষ্যভিতু কনের টাকলামাথা দোজবর
বস্তাপ্রতিম বানিয়ার বংশে এনেছিলুম হাইতোলা চিকেন-চাউনি
কাদাকাঙাল ঠ্যাঙ থেকে ঝরাচ্ছিলুম ঘেসো ঝিঁঝির সাম্ভা নাচ
আমি যে-নাকি ফানুসনাভি ব্যাঙ-থপথপে শুশুকমাথা আমলা
মাটিমাখা নতুন আলুর চোখে-দেখা দু-টাকা ডজন রামপ্রসাদী জবা
চাষির ঢঙে বলদ অনুসরণ করে পৌঁছেছিলুম বিধানসভার কুয়োতলায়
আমি যে-নাকি পোলকাফোঁটা পুঁইফুলে দুভাঁজ করা হেঁইয়োরত বাতাস
ঢেউ-চাবকানিো ঝড়ে যখন বঁড়শি-খেলা পুঁটির পাশে ভাসছি
তখন বুঝলি লম্বালম্বি করে কাটা কথাবাত্রার লাটিমছেঁড়া ঘুড়ি
আমি যে-নাকি ভূতলবাহী আওয়াজ-মিস্ত্রি হলদে-ল্যাঙোট বাবুই
চোখে-চোখে শেকলআঁকা ভিড়ের মধ্যে এঁদো বিভাগের কেঁদো
চিংড়ি-দাঁড়া আঙুল দিয়ে খুলছি বসে জটপাকানো মুচকি-ঠোঁটের হাসি
৯ জুন ১৯৯৮
শব্দের নিজস্ব কালখণ্ড
এক নম্বর গায়কের গাওয়া
বাংলাভাষী নৌকোয় চেপে
পাড়াবেড়ানি মেরুণ ম্যালেরিয়া
এই বাতাস-সুখী বাশবনে
মেশিনহাসি-ঠোঁটে পড়ে আছে
খড়ল্যাংটো দ্যাবতার পায়ে
পানাপুকুরে সবুজ জলখোদাই
গায়ে মেখে ছাগলগন্ধা বোউটি
যখন ভোররাতে স্বনামে ফিরলেন
দেহস্তাবকদের আলিঙ্গন ধুতে
খটকা লেগেছিল যে ওনার দালালটা
কাজের লোক নাকি যৌনকর্র্মী
২৪ জুলাই ১৯৯৮
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা
আমি তো বলতে গেলে দাঁতনখের চাষ ছেড়ে সাজলুম প্লাইকাঠের নেতা
চদ্মবেশ ধরলে দেখি আসল চেহারাখানা বেরিয়ে পড়েছে রে
স্ববিরোধিতা ছাড়া কি আর অন্য কোনো মৌলিক কাজ আছে ? বল!
আমি তো বলতে গেলে জরাজীর্ণ আকাশ জুড়ে ঢিললাচিল বুড়ো
ভান করার ভান করি আর তা জীবন নামে চালাই
সাঁতারু খেলানো জলে নৌকোর ছইয়ে সংসার পেতেছি
আমি তো বলতে গেলে পাষাণ-রিদয় পাথর ভেঙে দেখি
বালি-ঝুরঝুর চাউনি মেলে কাছিমখেকো বেতোরুগির দল
জলে-ডোবা পাঙাশ মেয়ের ঠোঁটে ডানাউড়াল হাসি খুঁজছে
আমি তো বলতে গেলে ঘৃতাহুতির ভ্যাজাল ধোয়াঁয় কেঁদে
সত্য বানাই মৃত্যু বানাই হুর্ধ-অধ গোলচক্কোর বানাই
সাপটা ছিল নিজের গর্তে হাত ঢুকিয়ে তাকেও তো ভুল বোঝাই
কলকাতা ২৭ নভেমবর ১৯৯৯
কার্যের কারণ
ধোঁয়ার প্রলেপ দেয়া কপালে যে আঘাত সারেনি
বাস্তবের দ্বারা প্রতারিত সেরকম এক ভবিষ্যতে
অতীতকে যতোটা আনলোড করা যায়
দুঃখ হল যে অনৈক্য আর আগের মতন নেই রে
দ্যাখ-না কেমন বেজে চলেছে তালাদেয়া বাড়ির টেলিফোন
আর ছিটকিনি-বন্ধ অন্ধকারে বিরক্ত হচ্ছি আমরা
১৯৯৭
শুদ্ধ চেতনার রহস্য
ঠিক আছে, লাফাও
অ্যালুমিনিয়াম-ফ্রেম কাঁচের জানালা খুলে কুড়ি-তলা থেকে
বাতাসে ঝাঁপাও তুমি টাঙাইল আঁচল উড়িয়ে
শূন্যে ভাসবে কালো ঢাল এলোকেশ
দু-পায়ে অচেনা নাচে পৃথিবীর রঙিন মাটিতে
নেমে এসো তুমি
তখন খামচে দেখো হাওয়ার শরীর কীরকম
খেলবে তোমাকে নিয়ে ওলোট পালোট
আমার পায়ের কাছে পড়ে তুমি ছত্রখান হও
খণ্ড-বিখণ্ড হাড় থ্যাঁতা মাংস নাড়িভুড়ি সব একাকার
ঠোঁট যোনি উরু নাভি পাছা স্তন আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে
সৌন্দর্য বিমূর্ত ক্বাথে মাছির খোরাক হবে তুমি
সব জড়ো করে তবু তুমি নও
তুমি সে-সময়ে রৌদ্রে ভাসমান
বুঝেছিলে মিথ্যে এই প্রারম্ভিক অধঃপতন ।
২১ আষাঢ় ১৩৯২
প্রথম প্রেম : ফয়েজ আহমদ ফয়েক
গরমের ছুটিতে খালি-পায়ে যখন নাজিমদের বাড়িতে
লুডো খেলতে যাই, কুলসুল আপা রাস্তা পেরোবার ঢঙে
বাঁদিক-ডানদিক তাকিয়ে দুহাতে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দ্যান
আমায় অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে এক হ্যাঁচকায় টেনে নিয়ে ।
আমি বলি, 'ভোজপুরি বলবেন, আমি উর্দু বুঝতে পারি না ।'
উনি বলেন, 'তুই চোখ বোজ, তাহলেই বুঝতে পারবি,
এ তো খুব সহজ রে ।' আমি চোখ বুজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি
একগাদা হাঁসমুর্গির মাঝে ।
কুলসুম আপা বলেন, 'মুঝে দে দে রসিলে হোঁঠ, মাসুমানা
পেশানি, হসিঁ আঁখে কে ম্যায় একবার ফির রঙ্গিনিয়োঁ মেঁ
ঘর্খ হো জাউঁ...'
আমি বলি, 'ধ্যাৎ কী করছেন কী, আমার লজ্জা করে ।'
উনি ওনার কালো মোটা ঠোঁটে বলতে থাকেন, 'মেরি হস্তিকো
তেরি এক নজর আগোশ মেঁ লে লে হমেশা কে লিয়ে
ইস দাম মেঁ মহফুজ হো জাুঁ জিয়া-এ হুস্ন সে জুম্মত-এ দুনিয়া
মেঁ ন ফির আউঁ...'
আমি বলি, আঃ ছাড়ুন না, এমন করছেন কেন আপা ?'
উনি বলেন, 'গুজিশতাঁ হসরতোঁ কে দাগ মেরে দিল সে
ধুল জায়েঁ...'
আমি বলি, 'না না না...'
আপা ওনার ঘুমন্ত কন্ঠস্বরে, 'ম্যায় আনে ওয়ালে গম কি
ফিকর সে আজাদ হো জাউঁ মেরে মাজি ও মুস্তকবিল সরাসর
মাভ হো যাঁয়ে মুঝে ওয়হ এক নজর, এক জাভেদানি সি
নজর দে দে ।'
আমি বললুম, 'রোজ রোজ এরকম করেন কেন?'
উনি বললেন, 'তবে যে তুই বলছিলিস উর্দু বুঝতে পারিস না!'
২ জানুয়ারি ২০০১
লালসেলাম হায়
মুখের গহ্বরে এক জান্তব গোঙানি-ডাক চলাফেরা করে
জেলহাজতের ভিড়ে ত্রিকালজ্ঞ ভিড় দেখে চমকে উঠি
এরা কারা হাতকড়া পরে ঠাঠা হাসে সারাদিন
বাইরে যারা রয়ে গেল ঝুঁকিয়ে দাঁতাল মাথা
তারাই বা কারা
জল্লাদের ছেড়ে দেয়া প্রশ্বাস বুক ভরে টানে
চাই না এসব ধন্দ
মশারি খাতিয়ে বিছানায় সাপ নারীর বদলে
নৌকোর গোলুই থেকে ছুরি হাতে জ্যোৎস্নায়
বুকের ওপরে বসবে লুঙি-পরা রোমশ সারেঙ
নাসারন্ধ্র থেকে বন্দুকের ধোঁয়া
'বল শালা শকুন্তলার আঙটি কোন মাছে আছে'
জানি তবু বলতে পারি না
মুখের ভেতর আঙটি জিভের তলায় আমি লুকিয়ে রেখেছি ।
২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯২
আনন্দধারা বহিছে ভূবনে
মাজুরিয়া শালডিহা কাঁঠালবেরা সরাই খানাকুল
বিকালধান মিরাডাঙা জগন্নাথপুর হরিনা জয়পুর
ধানডাংরি বাহানা ঘোষপুর দোগেড়িয়া নানুর
সাতশোল রাজাগ্রাম হাজিচক সিংকুরা বদনগঞ্জ
বিকালচক খড়গগড়া খাফনা রামনগর গড়বেতা
রাউতা কারাঙ্গা পারুলা আগরপাড়া উত্তরবিল
সরিষাকোলা ধোগেড়িয়া ঝলকা টাপুরিয়া পিঢলা
পাঁচকুড়ি বাজুয়াড়া মহাডিহা কদমপাট কেশপুর
চেচনিয়া বসনিয়া নিকারাগুয়া ভেয়েতনাম চিলে
কান্দাহার কিরকুক কাম্পুচিয়া তিমোর বেলসেন
আউশভিৎস অ্যাঙ্গোলা লাইবেরিয়া কাতিনের জঙ্গল
বুলডোজার পেলোডার কার্পেটবোমা দেইজি-কাতার
এজেন্ট-অরেঞ্জ ডিপ্লিটেদ-ইউরেনিয়াম ফেনোবারটিন
চলছে চলবে চলছে চলবে চলছে চলবে চলছে...
কলকাতা ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৩
দে গোরুর গা ধুইয়ে
আররে ইসলামভাই ---
আদাব । প্রণাম । সৎশ্রী আকাল । গুড ডে ।
বোমা ও বউমা-শাসিত ভুঁয়ে পাছড়িয়ে দিব্বি শুয়ে আছো ।
লকলকে অন্ধকারে । এ এক চমৎকম্মো । কোনো দিকে দিক নেই ।
ন্যুব্জ লোচ্চার ভিড়ে । মনীষা-জর্জর ঘোঁট-ঘটকের আলজিভবিহীন গোরে ।
বা হয়তো বহু আলজিভ নিয়ে । খালিপিলি ।
ইসলামভাই । বোবার গুষ্টি ছাড়া আর কেউ হলপ করে না ।
চিতশোয়া আছো বেশ । ইলশেকোমর বং-ললনারা তোমার গোরে গিয়ে গান গায় ।
কী গান ? না, 'অর্থালংকার দাও ভঁয়সামর্দিনী !'
রাধাক বুলিলঁ ঢপকথা । ঢপের আকাল নেই এপারে-ওপারে ।
দেখা আর হল কি তবুও ? ঠ্যাঙের জ্যামিতিনাট্য ? ভেনিশিয় অন্ধ জানালা ?
আররে ইসলামভাই ---
মধু হেম রবি দ্বিজু সতেদের ছেড়ে তুমি কবরে সিংহাসন পেলে ।
ভালোই তো । লুচ্চাতিলুচ্চারা আছে জমির ওপরে । ফংগবেনে । টেলিসুন্দুরীর গ্যাঞ্জামে ।
বুভুক্ষুদের কুরে-কুরে খেল ওরা । শিবের জটায় দেখো মরা সোঁতা-ধারা ।
ভেজালকান্তিদের পেপি-গান । করতালি কুড়ানিয়া উচাটন । বাতেলানন্দিত ।
জেনে রাখো : 'অশনি সংকেত বলতে কিছু বাকি নেই ।'
ষাঁড়াষাঁড়ি বৃংহণে সবায়ের কান কালা । চুল্লু-চনমনে আলো । দুদেঁড়ে বিন্দাস ।
ভুতুড়ে পাঁকের গর্ত ঠ্যাং ধরে টানে । কিন্তু উপায় নেই । কী করি ? কী করি ?
কী করে বোঝনি ইসলামভাই ---
বীণার আগুনে তুমি নিজেকে পোড়াবে ! ঘিরে ধরবে বাক-শেয়ালেরা !
গয়ংগচ্ছতি যুগে ? বোবা স্বরবিতানের চিকনিচিজ লাফড়া-মথিত কালে ?
বুঝলে ইসলামভাই । সবাই বিন্দাস আছে । আকখা ভারতে,
দুর্গম গিরি কান্তার মরু ত্রিস্তর ভোটাভুটি ! কবিতাও, বোলে তো ছক্কাস !
অবশ্য একটা ভালো । ধন্য হবার জন্যে এটুকু বেঁচেছে । তা-ও মন্দ কী !
তোমার গোরের দেশ ধেকে তিন তালাকের সস্তা ঝিরা এপারে আসছে দলে-দলে ।
ভর্তুকির জন্যে শুক্রিয়া ।
আদাব ইসলামভাই । প্রণাম । সৎশ্রী আকাল । গুড ডে ।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৪
কী বিষয় কী বিষয়
আররে রবীন্দ্রনাথ
তোমার সঙ্গেই তো নেচেছিলুম সেদিন
আঙুলের ইতিহাসে একতারার হাফবাউল ড়িং ড়াং তুলে
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের জমঘট থেকে সদর স্ট্রিটের লবঙ্গবাজারে
যেতে যেতে তুমি বললে, আমাগো শিলাইদহ থিকা আসতাসি
আলুমুদ্দিন দপতর যামু
আগুন আর জলের তৈরি তোমার ঠোঁটে
তখনও এক চিলতে ব্রহ্মসংগীত লেগেছিল কী গরম কী গরম
গ্যাবার্ডিনের আলখাল্লা ফেলে দিলে ছুঁড়ে
দেখলুম তোমার ফর্সা গায়ে জোঁক ধরেছে
বড়ো জোঁক বর্ষার জোড়াসাঁকোয়
সেলিমের দোকানে শিককাবাবের গন্ধে
নেড়েগুলা কী রান্ধতাসে জানতে চাইলে
ও বললে, না বুঝলুঁ? সাঁড়কে সালন ছে ! আঁহা দেখুঁ না চখকে
চায়ের ঠেকে টাক-মাথা চুটকি দাড়ি
ভ্লাদিমির ইলিচ আর সোনালি চুল ভারা ইভানোভা জাসুলিচ
আর তোমার মতন রুপোলি দাড়িতে অ্যাক্সেলরদ আর মারতভ
যার গাল আপনা-আপনি কাঁপছিল দেখে তুমি বললে
উয়াদের ধড়গুলা কুথায় ?
আমি আমার নাচ
থামাতে পারছিলুম না বলে তুমি নিজের একতারাটা দিতে চাইলে
কেননা তোমার পা থাকে নাচ যে পেরেছে খুলে নিয়ে গেছে
আর এখন তো দিনের বালায়ও লাইটপোস্টে হ্যালোজেন জ্বলে
কী আনন্দ কী আনন্দ
সদর স্ট্রিটের বারান্দায়
তোমার তিনঠেঙে চেয়ারখানা পড়ে আছে
হুড়োহুড়ি প্ররম করতে গিয়ে পায়া ভেঙে ফেলেছিলে
তারিখ-সন লেখা আছে জীবনস্মৃতিতে
কী ভালোবাসা কী ভালোবাসা
তোমার ফিটনগাড়ির ঘোড়া তো
কোকিলের মতন ডাকছে দাদু রবীন্দ্রনাথ
আর তোমার বীর্যের রেলিক্স থেকে কতজন যে পয়দা হয়েছিল
মাটি থেকে ছোলাভাজা তুলে খাচ্ছে
ওগুলা কী ? আমি বললুম কাক ।
ওগুলারে কী কয় ? আমি বললুম সেলিমকেই জিগেস করো,
ও এই অঞ্চলে তোলা আদায় করে । কী ঐশ্বর্য কী ঐশ্বর্য
২৪ আগস্ট ১৯৯৯
যা লাগবে বলবেন
কে চেল্লায় শালা
কে চেল্লায় এত ভোরবেলা?
গু-পরিষ্কার করেনি কাকেরা
মাছের বাজার থেকে ফেরেনি সবুজ মাছরাঙা
বকজোড়া আপিস যায়নি এখুনও!
কে চেল্লায়
কেন চেল্লায়, অ্যাঁ, কিসেরি বা র্যালা ?
আমি, আমি, হাহ
আমিই আওয়াজ দিচ্ছি চ্যাঁচাচ্ছি আমি
কোনোই বক্তব্য নেই
কোনোই কারণ নেই, স্রেফ
চিৎকারের জন্যে চিৎকার
চিৎকারের ভেতরে চিৎকার
১৯৯৬
দ্রোহ
এ-নৌকো ময়ূরপঙ্খী
তীর্থযাত্রী
ব্যাঁটরা থেকে যাবে হরিদ্বার
এই গাধা যে-দিকে দোচোখ যায় যায়
যাযাবর
ঘাট বা আঘাটা যেখানে যেমন বোঝে
ঘুরতে চাই গর্দভের পিঠে
মাথায় কাগুজে টুপি মুখে চুনকালি
পেছনে ভিড়ের হল্লা ।
১৯৯৬
টাপোরি
আমি যে-কিনা পালটি-মারা তিতিরের ছররা-খাওয়া আকাশ
জলে-ডোবা ফানুসপেট মোষের শিং থেকে জন্মেছিলুম
অলসচোখ দুপুরে পুঁতি-ঝলমলে নিম ঘাছতার তলায়
থাবা-তুলতুলে আদর খাচ্ছিলুম ভুরু-ফুরফুরে শ্যামাঙ্গী গৌরীর
হাতখোঁপায় গোঁজা বৃষ্টির কাছে নতশির স্বর্ণচাঁপার কোলে
আমি যে-কিনা গ্রিল-বসানো সকালমেঠো দিগন্তে দাঁড়িয়ে
মাড়ানো ঘাসের পদচিহ্ণ আঁকা শোকাচ্ছন্ন রোদের সোঁদাভূমিতে
শেষ-গড়াগড়ির বিছানায় কাঠকীটের রাত-ঘ্যাঙোর শুনেছি
ভাবছিলুম উদ্দেশভ প্রণোদিত হলেই খারাপ হতে যাবে কেন রে
পদ-অলঙ্কৃত করা গতরের ঘামে কি খাটুনির লবণকলা নেই
আমি যে-কিনা ডাহুককে জিগ্যেস করেছি প্রজাপতির ডানায় কী স্বাদ পাস
কানপটিতে খুরধ্বনি সেঁটে চিপকো খেলার তেজবরে কনের আদলে
জাহাজ-এড়ানো লাইটহাউসের আলোয় এক করাতদেঁতো হাঙর
যামিনী রায়ের আঁকা স্তনের কেরানির সঙ্গে মহাকরণের খাঁচালিফটে
হেঁকেছিলুম আরোহী-ফেলা পুং-ঘোড়ার লাগাম-ছেঁড়া হ্রেষা
আমি যে-কিনা উচ্চিংড়ের স্বরলিপিতা গাওয়া ফুসফাসুরে গান
বেড়াজালের হাজার যোনি মেলে ধরে রেখেছি ইলশেঝাঁকের বর্ণালী
স্বদেশি আন্দোলনের লাশঝোলা স্মৃতির গাবগাছের পাশের ঝোপে
শুকপোকায় কুরে-খাওয়া লেবুপাতার পারফিউমড কিনার বরাবর
পাথরকুচি কারখানা-মালিকের ঘাড়কামানো পাহাড় থেকে উড়ছি
কলকাতা ১ মার্চ ১৯৯০
শব্দে শব্দে বিবাহবিচ্ছেদ
আসলে আমি জিভে-খেলানো বেতার-রঙ্গে মাথামুড়োনো চাঁদ
লেড়কিছাপ ছোকরাদের ফাটলধরা আয়না থেকে বেরিয়ে
একশো ওয়াটের পাদপ্রদীপে ভোমরাভুরু মুদির ঠোঁটের ভাঁড়ে
বগলকামানো খেজুর-রসে মোদোমাতাল তাগড়া ঝড়ের ফেরিঅলা
আসলে আমি তালাবন্ধ মন্দিরের চোয়াল-ঝোলা সকালবেলায়
আদালতে জমা-দেয়া প্রেমপত্রের মাদুলিপরা ব্রয়লারঠ্যাঙ-খুনি
কাক-পরিত্যক্ত ছাদ থেকে ঠেলে-দেয়া ইডলিবুক খুকির হাতে
খড়ের গোছ দিয়ে পেটানো আধমরা-হাওয়ায় বাদুড়-হিরো চড়ুই
আসলে আমি শতেকখাগি সরকারের লাশের চোখে প্রাণভর্তি মাছি
হোমিওপ্যাথির কয়েকফোঁটা শিশির চেখে রসুনশ্বস প্রেমিক
প্রকৃতির মুক্তাঞ্চল নষ্টকরা মানুষের সংখ্যাচিহ্ণ ল্যাজে
চাবি দেয়া বার্ধক্যে কলের গানে গাইছিলুম শনিথানের হুকিংকরা ভজন
আসলে আমি পেতলের রেণু-ওড়ানো কাঁসরঘণ্টায় ঘাম-কালোয়াত বজ্র
ঘোড়ার খুরে ছন্দ তোলার পাথুরেপথে বাসি-নদীর জলে ভেসে
ল্যাংটামির মালিকানা ত্যাগের বয়সে পৌঁছে নির্ণয়ভারে কাবু
মাদারিখেল প্রযুক্তি চালিয়ে ঘোচালুম প্রতিলিপি আর নকলের তফাত
আসলে আমি পয়গম্বরি ব্যাবসায় লালে-লাল হিউজগতর মাল
জাতিস্মর বুদবুদে গপপো-বাহক রবারফোমের এমন এক পশু
শব্দে শব্দে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে ওত পেতেছি মলাট-দেয়া জ্বরে
বহরমপুর ২৩ জুলাই ১৯৯৮
ক্যাডারমঙ্গল
আমি ভাবলুম বুঝি উপায় নেই বলে প্রেমে পড়তে হল
ফলে ঝড় উঠলে কে সামলাবে মগডাল না শেকড় বল দিকি
আমি ভাবলুম বুঝি মেঘের কি আর দশবিশ কিলো ওজন নেই
যে কেষ্টবিষ্টুর মড়া না পচলে শবযাত্রায় শোক হবে না
আমি ভাবলুম বুঝি দুপুর থেকে বাজবিদ্যুৎ ঝুলে আছে আকাশময়
তাই স্বপ্নের যৌনতায় মুখহীন যুবতীদের ডলফিনদেহ ভিড়
আমি ভাবলুম বুঝি নরক অনেকটা মধ্য-কলকাতার মতন
নারী-রহিত পুরুষ আর পুরুষ-রহিত নারী বিছানায় সংলাপ বেচে
আমি ভাবলুম বুঝি মাথার মধ্যে যখন কাঠের সিঁড়ি চড়ার শব্দ
চাষিরা বুটজুতো পায়ে উট-হাঁকিয়ে লাঙল দিচ্ছে মরীচিকায়
আমি ভাবলুম বুঝি রাস্তার মালিক তো অবরোধের পাইকার
তলপেটের মহড়াটা ঢেঁকুরের না ডুকরে-কাঁদা খিদের কী এল-গেল
আমি ভাবলুম বুঝি রাঁঢ়বাজারে শততম প্রেমিকের আবির্ভাব হল
অথচ ফুলের টবে মাটি নেই শেকড়ে-শেকড়ে ছয়লাপ সংসার
কলকাতা মার্চ ১৯৯৯
সাজানো বাগানেরব পরের স্টপ
নেশাগ্রস্তের মাথা ঝুঁকিয়ে জয়াধানের রুদ্ধদ্বার শিস ছেড়ে
মাঙ্গলিক সাজসজ্জায় উড়ছে প্রজাপতির ভাবুক ঝাঁক
ভালোবেসে বিয়ে করবে বলে একজোড়া খুন্তেবকের আকাশে
রাগতস্বরে আরম্ভ হয়ে গেছে অর্ধস্ফুট বৃষ্টি
আর মৃগেল গৃহবধুর সঙ্গে ভাসমান দীর্ঘদেহী কালবোসের ঘাটে
নীরবতা পালন করছে কুলাঙ্গার অধ্যুষিত মহাশ্মশান
লাগোয়া রুগ্নকরুন বাতাসে-মোড়া রাজপথে সংশয়াচ্ছন্ন ষাঁড় -- ভদ্র বিনয়ী
মাধবীকঙ্কণ বাগানের পরেই এই ইকেবানা বাস স্টপ
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মুলো হাতে কয়েক দশকের কিউ ভেঙে প্রেম
আর মারামারিতে তফাত ধোঁয়াটে হয়ে আসছে আজকাল
খাঁটি-সত্য কঠিন-সত্য গভীরতম-সত্যের ভুলভুলাইয়ায়
আলোকপ্রাপ্তির ফুয়েল-সারচার্জ আগেই বাড়িয়েছে মিষ্টভাষী ঝিঁঝি
তখন সবে-দাড়িগোঁফ তরুণরা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ঘাম শুকোচ্ছিল
ভেতরে-ভেতরে নিভছিল তুষবুকের অনির্ণেয় পূর্ণিমা
দিল্লি ২৩ এপ্রিল ১৯৯৮
[ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ২০০৪-১৯৬১ বইটির প্রকাশক : আবিষ্কার প্রকাশনী, ১২এ বাঁশদ্রোণীঘাট রোড,
কলকাতা ৭০০ ০৭০, ফোন: ০৩৩-২৪১০-৫১৩২, মোবাইল: ০৯৮৩০৩৩১০৯২. দাম ভারতীয় ১৫০টাকা]
Labels:
অধুনান্তিক,
পশ্চিমবঙ্গ,
বাংলা কবিতা,
হাংরি আন্দোলন
Subscribe to:
Posts (Atom)